
বাংলাদেশের রাজনীতি ইতিহাসে কিছু মুহূর্ত আসে, যেগুলোকে রাজনৈতিক বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় window of opportunity—একটি সংক্ষিপ্ত সময়, যখন জনগণ পুরোনো বন্দোবস্ত ভাঙতে প্রস্তুত থাকে এবং নতুন কিছুকে গ্রহণ করার মানসিকতা তৈরি হয়।
জুলাই ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান ঠিক তেমনই একটি মুহূর্ত।
এই আন্দোলন শুধু সরকারবিরোধী ছিল না; এটি ছিল একটি প্রজন্মের ক্ষোভ, স্বপ্ন এবং নৈতিক প্রত্যাশার বিস্ফোরণ। সেই প্রজন্মের রাজনৈতিক প্রতিনিধিত্বের দাবিদার হিসেবেই এনসিপি (নতুন রাজনৈতিক শক্তি) সামনে আসে। কিন্তু আজ এনসিপির সামনে যে সিদ্ধান্ত—জামাতের সঙ্গে জোট—তা শুধু একটি কৌশলগত ভুল নয়; এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক আত্মহত্যা।
আদর্শিক বিশ্বাসঘাতকতা ও ব্র্যান্ড ধ্বংস
এনসিপির মূল শক্তি তরুণ প্রজন্ম। এই প্রজন্ম:
ধর্মনিরপেক্ষ ও আধুনিক রাষ্ট্রকাঠামোর পক্ষে,
অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচারে বিশ্বাসী,
রাজনীতিতে নৈতিকতা ও স্বচ্ছতা প্রত্যাশী।
এই তরুণদের চোখে জামাতে ইসলামীর সঙ্গে জোট মানে আদর্শিক বিশ্বাসঘাতকতা। এটি শুধু একটি জোট নয়, এটি এনসিপির রাজনৈতিক পরিচয়ের brand dilution।
একটি নতুন দল প্রথম দিকে যে পরিচয় তৈরি করে, সেটিই ভবিষ্যতে তার সবচেয়ে বড় সম্পদ। জামাত জোট সেই সম্পদ ধ্বংস করবে।
ভোটার বাস্তবতা: ‘নো ম্যানস ল্যান্ড’-এ আটকে যাওয়া
বাংলাদেশের ভোটার মানচিত্র খুব পরিষ্কার:
শহুরে শিক্ষিত তরুণ ও মধ্যবিত্ত জামাতবিরোধী,
ধর্মীয় রক্ষণশীল ভোটাররা সরাসরি জামাতকেই ভোট দিতে চায়,
পরিবর্তনকামী গ্রামীণ যুব সমাজ সাম্প্রদায়িক রাজনীতিতে বিভ্রান্ত হয়।
ফলে এনসিপি জামাতের সঙ্গে জোট করলে এমন এক অবস্থানে পড়বে, যেখানে কেউই তাদের পুরোপুরি নিজের বলে গ্রহণ করবে না।
রাজনীতিতে এটাকে বলা হয় no man’s land—সবচেয়ে বিপজ্জনক অবস্থান।
২৭০ আসনের ভোটারদের রাজনৈতিক পরিত্যাগ
যদি এনসিপি মাত্র ৩০টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে, তাহলে দেশের বাকি ২৭০ আসনের সমর্থকদের কাছে বার্তা যাবে:
“আপনাদের ভোট আমাদের দরকার নেই।”
রাজনৈতিক মনোবিজ্ঞানে একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য হলো—ভোটারের প্রথম ভোট অভিজ্ঞতা তার দলীয় পরিচয় গঠনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
এই ২৭০ আসনের তরুণরা বিকল্প দল খুঁজবে, সেখানে অভ্যস্ত হবে, এবং পাঁচ বছর পর তাদের ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব হয়ে যাবে।
“টাকা নেই, সংগঠন নেই”—এই অজুহাত কতটা সত্য?
নতুন দলগুলো প্রায়ই বলে: “৩০০ আসনে লড়াই করার মতো অর্থ বা সংগঠন আমাদের নেই।”
কিন্তু ২০২৫ সালের রাজনীতি ১৯৯৫ সালের রাজনীতি নয়।
আজ:
ক্রাউড-ফান্ডিং একটি পরীক্ষিত মডেল,
সোশ্যাল মিডিয়া প্রচারণা ঐতিহ্যবাহী ক্যাম্পেইনের চেয়ে কম খরচে বেশি কার্যকর,
তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের নেটওয়ার্ক একটি শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি করতে পারে।
বারাক ওবামা, বার্নি স্যান্ডার্স, ভারতের AAP—সবাই প্রমাণ করেছে যে জনগণের ছোট অনুদান বড় রাজনৈতিক শক্তিতে রূপ নিতে পারে।
“টাকা নেই”—এটি বাধা নয়, এটি দৃষ্টিভঙ্গির সমস্যা।
প্রথম নির্বাচনের মনস্তত্ত্ব
নতুন দলের জন্য প্রথম নির্বাচন শুধু আসন জয়ের প্রশ্ন নয়; এটি একটি পরিচয় নির্মাণের মুহূর্ত।
এই নির্বাচনেই মানুষ ঠিক করে:
দলটি আদর্শিক না সুবিধাবাদী,
সাহসী না ভীরু,
পরিবর্তনের প্রতীক না পুরোনো রাজনীতির আরেক সংস্করণ।
জামাত জোট এনসিপিকে চিহ্নিত করবে একটি opportunistic দল হিসেবে—যে আদর্শ নয়, সুবিধাকে অগ্রাধিকার দেয়।
সংখ্যার হিসাব: জোট বনাম একক লড়াই
জামাত জোট করে ৩০ আসনে লড়লে সর্বোচ্চ ২৫–৩০টি আসন পাওয়া যেতে পারে।
কিন্তু সারাদেশে ভোটশেয়ার থাকবে সীমিত, উপস্থিতি থাকবে আংশিক, ভবিষ্যৎ থাকবে অনিশ্চিত।
অন্যদিকে, ৩০০ আসনে এককভাবে লড়ে যদি ১০–১২% ভোটও পাওয়া যায়, সেটি এনসিপিকে দেশের তৃতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত করতে পারে।
রাজনীতিতে ভোটশেয়ার ভবিষ্যতের মুদ্রা—আসন নয়।
ইতিহাসের কাছে দায়বদ্ধতা
জুলাই ২০২৪-এর আন্দোলনে যারা প্রাণ দিয়েছে, যারা আহত হয়েছে, যারা রাস্তায় নেমে স্বপ্ন দেখেছে—এনসিপি শুধু তাদের প্রতিনিধি নয়, তাদের কাছে জবাবদিহিও আছে।
একটি প্রশ্ন ইতিহাস বারবার করবে:
“তোমরা ক্ষমতার জন্য লড়েছিলে, নাকি পরিবর্তনের জন্য?”
জামাত জোট সেই প্রশ্নের উত্তর আগেই লিখে দেবে।
শেষ কথা
রাজনীতিতে কিছু সিদ্ধান্ত point of no return তৈরি করে।
এনসিপির জন্য জামাত জোট ঠিক তেমনই একটি সিদ্ধান্ত।
স্বল্পমেয়াদে কিছু আসন পাওয়া যেতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে হারাবে:
তরুণ প্রজন্মের বিশ্বাস,
নৈতিক উচ্চভূমি,
ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের সম্ভাবনা।
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন আরেকটি “ছোট সুবিধাবাদী দল” চায় না।
এটি চায় সাহসী, আদর্শভিত্তিক, আপসহীন একটি নতুন শক্তি।
প্রশ্ন একটাই—
এনসিপি কি সেই শক্তি হতে চায়, নাকি ইতিহাসের পাদটীকায় হারিয়ে যেতে চায়?