আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়: প্রেক্ষাপট ও প্রতিক্রিয়া

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের রায়: প্রেক্ষাপট, বিশ্লেষণ ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া (২০২৫)

১৭ নভেম্বর ২০২৫ তারিখে ঢাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ (আইসিটি-১) তাদের শেষ মেয়াদের রায় ঘোষণা করে। কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত ২০২৪ সালের ছাত্র-নির্যাতন মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সাবেক গৃহ-সচিব আসাদুজ্জামান খান কামালকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধের’ দায়ে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এই রায় বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন, মানবাধিকার অঙ্গন এবং আন্তর্জাতিক সমাজে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

১. রায় ঘোষণার সারসংক্ষেপ

ট্রাইব্যুনাল রায়ে বলেছে—

  • শেখ হাসিনা “incitement”“orders to kill” এর মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে সহিংসতা পরিচালনা করেছেন।
  • আন্দোলন দমনে ড্রোন, হেলিকপ্টার ও প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহারের নির্দেশ তিনি দিয়েছেন বলে তদন্তে উঠে এসেছে।
  • গৃহ-সচিব কামালকে সরাসরি সহযোগিতার কারণে একই অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
  • সাবেক ডিএমপি কমিশনার চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনকে সাক্ষ্য-সহযোগিতার ভিত্তিতে ৫ বছরের দণ্ড ও ভবিষ্যৎ মওকুফের শর্ত দেওয়া হয়।
  • রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের সুযোগ রাখা হয়েছে।

২. ২০২৪ সালের আন্দোলনের পটভূমি

২০২৪ সালের ১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চাকরিতে কোটা পুনর্বহালের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়।

চোখে পড়ার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়:

  • প্রথম দুই সপ্তাহে পুলিশের গুলিতে ৫ জন নিহত, ৪০০+ আহত
  • পরবর্তীতে জাতিসংঘের রিপোর্ট: প্রায় ১,৪০০ নিহত (জুলাই–আগস্ট ২০২৪)
  • সরকার শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালায়
  • এই অভিযানকে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ ওঠে রাষ্ট্রীয়ভাবে হত্যার নির্দেশ দেওয়ার

এই প্রেক্ষাপটেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের আওতায় মামলা হয়।

৩. ট্রাইব্যুনালের পর্যবেক্ষণ ও অভিযোগ

ট্রাইব্যুনাল বলেছে—

  • শেখ হাসিনা ছিলেন “অপরাধের মস্তিষ্ক” (Mastermind)
  • প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীকে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশ দেন
  • জেনেভা কনভেনশন এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ আইন লঙ্ঘিত হয়েছে
  • অফিসিয়াল ফোনালাপ, ভিডিও ফিড, ড্রোন ডাটা—সব মিলিয়ে সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে

প্রতিরক্ষাপক্ষ এই অভিযোগ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে দাবি করলেও, ট্রাইব্যুনালের মতে সেগুলোর পক্ষে শক্ত প্রমাণ ছিল না।


৪. রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষ্য–প্রমাণ

মূল প্রমাণগুলো ছিল—

ভাইরাল ডিএইউ ছাত্র আবু সাঈদের গুলিবিদ্ধ হওয়ার ফুটেজ

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও নিরাপত্তা বাহিনীর ফোনালাপ

সেনা–পুলিশ কমান্ড লাইন অডিও

প্রত্যক্ষদর্শী ও চিকিৎসকদের সাক্ষ্য

রাষ্ট্রপক্ষের বক্তব্য ছিল—
“মহামারি নয়, পরিকল্পিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ছিল ছাত্র হত্যাকাণ্ড।”

৫. অন্তর্বর্তীকালীন ইউনূস সরকারের ভূমিকা

২০২৪ সালের সহিংসতার পর Nobel বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসে। এই সরকার—

  • স্বচ্ছ তদন্তের প্রতিশ্রুতি দেয়
  • তিন সদস্য বিশিষ্ট ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন করে
  • প্রধান প্রসিকিউটর হিসেবে Md. সাজেদুল ইসলামকে নিয়োগ দেয়

তবে আওয়ামী লীগ রায়কে “রাজনৈতিক প্রতিশোধ” বলে আখ্যা দিয়েছে।

৬. জনগণের প্রতিক্রিয়া ও নিরাপত্তা পরিস্থিতি

সমর্থন

  • নিহত ছাত্রদের পরিবার ন্যায়বিচার পাওয়ার অনুভূতি প্রকাশ করেছে
  • একাডেমিক এলাকা ও ঢাকার বিভিন্ন স্থানে মিষ্টি বিতরণ
  • সহিংসতা আপাতত নিয়ন্ত্রণে

সমালোচনা

  • আওয়ামী লীগ ও তাদের মিত্র দলগুলো রায়কে ‘অবৈধ’ ও ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ বলছে
  • রায়ের আগে কয়েকটি গ্রেনেড হামলা ও গাড়িতে অগ্নিসংযোগে উত্তেজনা ছিল

৭. আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

  • জাতিসংঘ মানবাধিকার অফিস ১,৪০০ নিহতের রিপোর্ট পুনরায় উল্লেখ করেছে
  • হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মৃত্যুদণ্ড বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে
  • পশ্চিমা দেশগুলো সরাসরি মন্তব্য না করলেও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বড় আলোচনা চলছে